প্রকাশিত: Fri, Dec 2, 2022 1:27 PM
আপডেট: Wed, Feb 5, 2025 9:53 PM

ভয়ের আবেগ, বোধ ও নিয়ন্ত্রণ

মাসুদ রানা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পাঠকালের একটি ঘটনা বলি। তখন আমি মহসীন হলের ছ’তলায় একটি সিঙ্গেল রুমে থাকতাম। একরাতে রুমে বসে পড়ছিলাম, এমন সময় ভূমিকম্প হলো এবং ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। অন্ধকার ও কম্পমান পরিবেশটি সত্যিই ভীতিকর ছিল। কিন্তু ভয় করলে কি বিপদ কাটে বা কমে? না, বিপদজনক পরিস্থিতিতে একদম স্থির থাকার একটি বৈশিষ্ট্য আমি রাজনীতি ও আন্দোলন করতে গিয়ে রপ্ত করেছিলাম, যার প্রেরণা আমি পেয়েছিলাম একটি উপন্যাস পড়ে। তাই, ভয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য না হয়ে, টলতে টলতে কোনোক্রমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। লক্ষ করলাম প্রচ- চিৎকার ও দৌড়াদৌড়িতে সকলই পালাচ্ছে। আধো আলো-আঁধারিতে আমি বুঝলাম অন্তত: একজন নীচের কোনো একটি ফ্লোর থেকে লাফ দিয়েছে (পরে জেনেছি সে আহত হয়েছিলো, নিহত হয়নি)। আমি তখন ডায়রি লিখতাম এবং ডায়রি আমার পড়ার টেইবলেই থাকতো। মাঝে-মাঝে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যেতো বলে মোমবাতিও ছিল। আর, তখন ধূমপান করতাম বলে জিন্সের পকেটেই একটা লাইটার ছিল। তাই, মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘটনাটি ডাইরিতে লিখলাম।

পরিস্থিতি শান্ত হলেও বিদ্যুৎ ফিরে এলে ধীরে ধীরে প্রায় সবাই ফিরে এলো। আমার ছ’তলার প্রতিবেশীরাও ফিরে এলো এবং আমাকে মোমের আলোতে পড়ার টেবিলে বসে থাকতে দেখে বিস্মিত বেশ কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আমার কি মরণের ভয় আছে কি-না। আমি বললাম, আছে। কিন্তু ভূমিকম্পের মধ্যে ছয়তলা থেকে দৌড়ে নেমে আমি কীভাবে বাঁচতাম, যদি বিল্ডিংটি ভাঙ্গতে শুরু করতো? এর চেয়ে স্থির থেকে পরিস্থিতি বুঝে বাঁচার চেষ্টা করাই কি ভালো নয়? মিছিলে পুলিশ আক্রমণ করলে আমি কখনও আগে দৌঁড়াতাম না। আমার কমরেডদের নিরাপদে পালানো নিশ্চিত করার পরই আমি সবার শেষে দৌড়াতাম। এতে একটা সুবিধা হতো এই যে, পেছন থেকে কেউ আমার গায়ের পড়ার সুযোগ থাকতো না একমাত্র পুলিশের লাঠি বা হাত ছাড়া, যা আমি ক্ষিপ্রতার সাথে সহজেই এড়াতে পারতাম। আবেগ নিশ্চয় থাকবে, কিন্তু সে-আবেগকে হতে হবে বোধের নিয়ন্ত্রণে। ইংলিশ সংস্কৃতিতে আবেগপ্রবণ হওয়া অপরিপক্কতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। ইংরেজি ভাষায় কাউকে ইমোশন্যাল বলার অর্থ হচ্ছে তাকে অপরিপক্ক হিসেবে নির্দেশ করা। আমার মনে হয়, পরিপক্কতা ও অপরিপক্কতা ব্যক্তির বিকাশগত স্তর যেমন নির্দেশ করে, তেমন একটি জাতিরও বিকাশের স্তরকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ, ব্যক্তির মতো একটি জাতিও পরিপক্ক কিংবা অপরিপক্ষ হতে পারে। পারে না? পরিশেষে, আবেগ মানুষের প্রকৃতি, আর এর নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ হচ্ছে সংস্কৃতি। আনন্দ হোক, কিংবা ভয় হোক, কিংবা ঘৃণা হোক, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখাই সভ্য ও সংস্কৃতিমান হওয়া।